Magic Lanthon

               

রায়হানুল রানা

প্রকাশিত ২১ ডিসেম্বর ২০২২ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

ইআইসিটিভি, পিছিয়ে পড়া মানুষের এগোনোর স্বপ্ন

রায়হানুল রানা

১.

ঠিক সকাল নয়টায় তিনি ক্লাসে উপস্থিত হন। ক্লাস সময়মতো শুরু হলেও এর শেষ কখন হবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর কেউই তা জানে না। বেশিরভাগ দিনের ক্লাস এগিয়ে চলে নতুন কিছু একটা সৃষ্টির লক্ষ্য নিয়ে। ফলে প্রত্যেককেই এক ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে আসতে হয়; যাতে তারা ক্লাসে কাজ করতে গিয়ে কোনো সমস্যায় না পড়েন। ক্লাস শুরু হয় চিত্রনাট্য লেখার নিয়ম দিয়ে; আর শেষে সৃষ্টি হয় একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্রনাট্য। এই করতে গিয়ে কোনোদিন সকাল থেকে স্নিগ্ধ বিকেল, কখনওবা দিন গড়িয়ে রাত নেমে আসে। ক্লান্তি-আনন্দমিশ্রিত সে-এক ভিন্ন রকম পাওয়া- অনেকটা জীবনক্ষয়ে যাওয়ার বিপরীতে মহৎ সৃষ্টির অনুভূতি। সুখের কথা হলো, আপনি চাইলেই এই ক্লাসের একজন হতে পারেন; ওই মানুষটির সঙ্গে ক্লাসও করতে পারেন। সমস্যা হলো আপনাকে এজন্য যেতে হবে বেশখানিকটা দূরে, লাতিন আমেরিকার দেশ কিউবায়। সেখানে চলচ্চিত্রের ওপর অসাধারণ এই ক্লাসগুলো নেন নোবেল বিজয়ী প্রখ্যাত কলম্বিয় লেখক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কুয়েজ।

শুধু মার্কুয়েজ নয়, আরও নানা কারণে কিউবার আন্তর্জাতিক সিনেমা ও টেলিভিশন স্কুল (ইআইসিটিভি) নামের এই প্রতিষ্ঠানটি সারা বিশ্বের সিনেমাপাগল শিক্ষার্থীদের কাছে সমধিক পরিচিত হয়ে উঠেছে। এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার একটু পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য এই প্রতিষ্ঠানটি সৃষ্টি করেছে চলচ্চিত্রশিক্ষার এক অবারিত সুযোগ। স্কুলটির অনন্যতা আরও আছে- স্কুলের শিক্ষক, শিক্ষার্থী এমনকি কর্মচারীদেরও সারা বছর খাবারের জন্য শাকসবজি কিনতে হয় না। অনেকে ভাবছেন, তারা কি তাহলে শাকসবজি খায় না? বিষয়টি মোটেও সে-রকম নয়। স্কুলের ১০০ একর জমিতে সবার সহযোগিতায় সারা বছর চলে শাকসবজির চাষাবাদ। আর তাই সবার মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে দেওয়া হয়।

 

২.

লাতিন আমেরিকার মুক্তার দেশ কিউবা। দেশটি দীর্ঘ শাসন ও শোষণের মধ্য দিয়ে বর্তমান অবস্থায় এসেছে। ইউরোপ থেকে আমেরিকা, কে করেনি তাদের শোষণ? আর এই শোষণ থেকে মুক্ত হতেও তাদের কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। তাই কেবল লাতিন আমেরিকা নয়, সারা পৃথিবীতে বিপ্লবের আরেক নাম হয়েছে কিউবা। ঐতিহ্যগতভাবেই লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর নিজস্ব কিছু সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য আছে, যা সবসময়ই তাদের শিল্প সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। যার অন্যতম একটি অংশ হচ্ছে চলচ্চিত্র। ১৮৯৫ সালে ফ্রান্সে লুমিয়ের ভ্রাতৃদ্বয়ের হাত ধরে যখন চলচ্চিত্রের উদ্ভব হলো ঠিক তার বছর দুই পরে পেসো দেল প্রাদো #১২৬১ এর মাধ্যমে কিউবাতে এর যাত্রা শুরু। এরপর থেকে লুমিয়েরদের তৈরি চলচ্চিত্রগুলো এখানে আমদানি করে বিভিন্ন সিনেমাঘর-এ প্রদর্শন হতে থাকে।

প্রদর্শিত এই চলচ্চিত্রগুলোর প্রতি সেখানকার জনগণ সাড়াও দেয়। এতে চলচ্চিত্রের প্রতি জনগণের এক ধরনের চাহিদা গড়ে ওঠে। আর এই চাহিদা এমন ছিলো যে, সেখানকার জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে ছবি দেখতো। ফলে জনগণের এই চাহিদা দেখে চলচ্চিত্রশিল্প গড়ে উঠতে থাকে। এক পর্যায়ে চলচ্চিত্র আমদানি করার পাশাপাশি কিউবানরা নিজেরা সিনেমা নির্মাণে উৎসাহী হয়। কিন্তু নির্মিত চলচ্চিত্রগুলো শৈল্পিকগুণের অভাবে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারে না। চলচ্চিত্রের চাহিদার এই চাপে ফ্রান্সকে টপকে কিউবার বাজারে প্রবেশের সুযোগ লুফে নেয় পশ্চিমা চলচ্চিত্র কোম্পানিগুলো। তারা অলীক কাহিনী, বিকৃত ইতিহাস ও যৌনতায় ভরপুর সিনেমা দিয়ে বাজার সয়লাব করে ফেলে। সময়ের আবর্তে গতানুগতিক ধারার এই সিনেমা দেখতে দেখতে সাধারণ জনগণ এক সময় ক্লান্ত হয়। তারা নতুনত্ব খুঁজতে থাকে। তবে এবার সুযোগ হাতছাড়া করে না কিউবার পরিচালকরা। বাস্তবকাহিনীর ভিত্তিতে টমাস গুতিয়ারেজ আলিয়া ও হুলিয়ো গার্সিয়া এস্পিনোজা নির্মাণ করে এল মেগানো নামে নব্যবাস্তববাদ ধারার এক প্রামাণ্যচিত্র। যার বিষয়বস্তু ছিলো কয়লা শ্রমিকদের শোষণের ইতিহাস।

এবার দর্শক নয়, বাধ সাধে সরকার। বিষয়বস্তুর চোটে চলচ্চিত্রটিকে তৎকালীন সরকার বাজেয়াপ্ত ও নিষিদ্ধ করে। কারণ হিসেবে দেখানো হয়, সরকারের বিরুদ্ধে চলচ্চিত্রটি কথা বলেছে; দ্বিতীয়ত, পশ্চিমা চলচ্চিত্র ছাড়া অন্য কোনো চলচ্চিত্রশিল্প সেখানে গড়ে উঠুক সরকার নাকি তা চায় না! দেশিয় চলচ্চিত্রের প্রতি সরকারের এ-ধরনের আচরণের অবশ্য কারণও ছিলো-তৎকালীন বাতিস্তা সরকার ছিলেন পশ্চিমা মদদপুষ্ট। যুক্তরাষ্ট্রের মদদে সেই সরকার কিউবায় স্বৈরশাসন চালায় ১৯৩৩ থেকে ১৯৫৯ পর্যন্ত। ১৯৫৯-এ এসে সময়ের চাকা ঘুরে যায়, ফিদেল কাস্ত্রোর নেতৃত্বে বিপ্লবের মধ্য দিয়ে পতন ঘটে বাতিস্তা সরকারের।

এরপরের ইতিহাসটা একেবারেই ভিন্ন। ক্ষমতায় গিয়েই ফিদেল কাস্ত্রোর বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক সরকার সবকিছু পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়। আর এই পরিবর্তনের ধারায় একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে ছিলো চলচ্চিত্র। ফলে নব্যবাস্তববাদ ধারার চলচ্চিত্র আবির্ভাবের জন্য কিউবানদের বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। বিপ্লবের ঠিক এক বছরের মাথায় ১৯৬০ সালে চলচ্চিত্র উন্নয়নে প্রতিষ্ঠা করা হয় ইন্সটিটিউট অব সিনেমাটিক আর্ট অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (আইসিএআইসি)। আইসিএআইসি-এর ওপর ন্যস্ত করা হয় দেশটির চলচ্চিত্রের এগিয়ে যাওয়ার পুরো ভার।

এর কিছুদিন পর নতুন ধারার ছবিকে সহায়তা দিতে ফিদেল কাস্ত্রোর সহযোগিতায় গঠন করা হয় একটি ফাউন্ডেশন। আর এই ফাউন্ডেশন গঠনের মধ্য দিয়ে বীজ রোপিত হয় একটি পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র স্কুলের। ভাবা হচ্ছিলো, এটি হবে সেই স্কুল যা লাতিন আমেরিকার চলচ্চিত্রকে একটি নতুন মাত্রায় নিয়ে যাবে। যার মাধ্যমে উন্নয়ন ঘটবে গোটা তৃতীয় বিশ্বের চলচ্চিত্রের। পিছিয়ে পড়া মানুষদের স্কুল হবে এটি। এর আগে অবশ্য একই ধরনের চিন্তা করা হয়েছিলো সোভিয়েত রাশিয়ায়। চলচ্চিত্রের জন্য বিশ্বের প্রথম শিক্ষায়তন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তারা এর উন্নয়নের কথা ভেবেছিলো।

১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের পর লেনিন চলচ্চিত্র শিল্পকে গুরুত্বপূর্ণ শিল্পমাধ্যম হিসেবে উল্লেখ করেন। এর ফলে লেনিনের উদ্যোগে ১৯১৯ সালে অল ইউনিয়ন স্টেট ইন্সটিটিউট অব সিনেমাটোগ্রাফি শিক্ষাকেন্দ্রটি স্থাপিত হয়। এখানে সারা পৃথিবীর সমমনা রাষ্ট্রের নাগরিকরা পড়ার সুযোগ পেতে থাকে। ৯০র দশকে শুরু হয় সোভিয়েত রাশিয়ার পতন। এর পরিণতিতে ১৯৮৬-তে এসে মস্কোর সেই চলচ্চিত্র স্কুলের নাম থেকে অল ইউনিয়ন স্টেট বাদ দিয়ে গেরাসিমভ ইন্সটিটিউট অব সিনেমাটোগ্রাফি নামকরণ করা হয়। বিষয়টি লক্ষ করুন, ৮৬-তে সোভিয়েতের স্কুল থেকে অল ইউনিয়ন স্টেট বাদ পড়ছে, অন্যদিকে সেই বছরই কিউবায় গড়ে উঠছে আরেকটি চলচ্চিত্র স্কুল। বিষয়টি অনেকটা নদীর একূল ভেঙে ওকূল গড়ার মতো।

 

 

৩.

রাজধানী হাভানা থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে সান আন্তোনিও দে লস বানো-তে প্রতিষ্ঠা করা হয় এই চলচ্চিত্র স্কুল। লাতিন আমেরিকার চলচ্চিত্রকে বিস্তৃত করার লক্ষ্যে চার মহান ব্যক্তির চেষ্টায় এই স্কুলটি গড়ে ওঠে। তাদের অন্যতম চিত্রনাট্য পড়ানো সেই শিক্ষক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কুয়েজ, যিনি শিক্ষকতার পাশাপাশি স্কুলটির প্রেসিডেন্ট পদও অলঙ্কৃত করেন। দ্বিতীয় জন, আর্জেন্টিনার বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক ফার্নান্দো বিরি, যিনি এই প্রতিষ্ঠানের পরিচালকদেরও একজন। আর তাদের সঙ্গে রয়েছেন কিউবার খ্যাতিমান চলচ্চিত্র পরিচালক টমাস গুতিয়ারেজ আলেয়া এবং বর্তমান সংস্কৃতিমন্ত্রী ও চলচ্চিত্রনির্মাতা হুলিয়ো গার্সিয়া এস্পিনোজ। শুরুতে এর নাম লাতিন আমেরিকান চলচ্চিত্র স্কুল থাকলেও পরবর্তীতে তা আন্তর্জাতিক সিনেমা ও টেলিভিশন স্কুল (ইআইসিটিভি) নামে পরিচিতি পায়।




অবশ্য স্কুলটির শুরুর ইতিহাস মোটেও এতো সরল ছিলো না। শুরুতে উদ্যোক্তারা স্কুলটির জন্য কোনো জায়গা ঠিক করতে পারছিলেন না। এক পর্যায়ে ১৯৮৬-এর ১৫ ডিসেম্বর গ্রামের একটি স্কুলের ভবন ধার নিয়ে সেখানে কার্যক্রম শুরু হয়। শত প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও এর স্বপ্নদ্রষ্টারা হাল ছাড়েননি; তারা স্বপ্ন দেখেছিলেন এমন একটি প্রতিষ্ঠানের যেটা পরিবর্তনের কথা বলবে। তারা রাষ্ট্রের কাঠামোর পরিবর্তনের সমান্তরালে চলচ্চিত্র শিল্পেরও পরিবর্তনের কথা ভেবেছিলেন। কেননা তারা বিশ্বাস করতেন, তাদের নিজেদের চাহিদা অনুযায়ী চলচ্চিত্র তৈরি করতে না পারলে, তাদের অর্জিত সমাজব্যবস্থার কোনো মূল্য থাকবে না। ফলে স্কুলটি নিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রমে তারা একটুও পিছপা হননি।

এ-ক্ষেত্রে সবসময় ছায়ার মতো পাশে থেকে উৎসাহ যুগিয়েছিলেন দেশটির রাষ্ট্রপতি ফিদেল কাস্ত্রো। অল্প সময়ের মধ্যে কাস্ত্রো-সরকার স্কুলগৃহ তৈরি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়। শুরুতে স্কুলে ৩০০ শিক্ষার্থীর পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে আসন বাড়ানোর প্রয়োজন দেখা দেয়। নতুন একটি বড়ো ভবন নির্মাণের পাশাপাশি আসন বাড়িয়ে ৮০০ করা হয়। তবে নতুন স্কুল ভবন উদ্বোধনের পর ভাড়া করা সেই স্কুলটিকে অবশ্য ভুলে যাননি উদ্যোক্তারা; তারা বিপদের বন্ধু সেই ভবনের নামকরণ করেন আদি স্কুল ভবন। এটিকে তারা স্মৃতি হিসেবে সংরক্ষণ করতে থাকেন।

স্কুলতো হলো, এবার যারা পড়াচ্ছেন তাদের নিয়েও কথা বলা জরুরি। তাদের কাউকে কাউকে আপাত সাহিত্যিক, রাজনীতিক কিংবা গতানুগতিক চিত্রপরিচালক মনে হলেও প্রাতিষ্ঠানিক জায়গা থেকে তাদের চলচ্চিত্র নিয়ে বোঝা-পড়ার জায়গাটা কিন্তু ঈর্ষণীয়। উদ্যোক্তা ও শিক্ষক হিসেবে যে-চারজনের নাম বারবার ঘুরেফিরে এসেছে তারা সবাই রোমের বিখ্যাত এক্সপেরিমেন্টাল সিনেমাটোগ্রাফি সেন্টারের ও সিজার জাভাত্তিনির ছাত্র ছিলেন। তাই অনেকে আদর করে কিউবার এই চলচ্চিত্র স্কুলটিকে কখনও কখনও রোমের স্কুলের ধর্মসন্তান বলে ডাকে।

 

৪.

চলচ্চিত্র নিয়ে এই স্কুলে তিন বছর মেয়াদি কোর্স করা হয়। আপনি সাতটি আলাদা বিষয়ে পড়তে পারবেন- ক) পরিচালনা, খ) চিত্রনাট্য রচনা, গ) তথ্যচিত্র নির্মাণ, ঘ) সম্পাদনা, ঙ) প্রোডাকশন, চ) সিনেমাটোগ্রাফি ও ছ) শব্দ প্রকৌশল। আগেই বলা হয়েছে, লাতিন আমেরিকার পাশাপাশি এই স্কুলে এশিয়া ও আফ্রিকার শিক্ষার্থীরা পড়ার সুযোগ পায়। এরই ধারাবাহিকতায় প্রতি বছর বিদেশ থেকে ৪২ জন শিক্ষার্থী এখানে পড়তে আসে। এই ৪২ জনকে ভাগ করে সাতটি বিষয়ে পড়ার ব্যবস্থা করা হয়। এই ৪২টি আসনের বিপরীতে অবশ্য প্রতি বছর ৩০টিরও বেশি দেশ থেকে প্রায় পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী আবেদন করে।

বিদেশি শিক্ষার্থী হিসেবে আবেদন করার জন্য আপনাকে কিছু শর্তপূরণ করতে হবে। চাইলে সব বয়সীরা এখানে আবেদন করতে পারবে না। আবেদনকারীর বয়স অবশ্যই ২২ থেকে ২৮ বছরের মধ্যে হতে হবে। তাকে যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে কমপক্ষে অধ্যয়নের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে দুই বছর। এছাড়া যে-সাতটি বিষয়ে (পরিচালনা, চিত্রনাট্য রচনা, তথ্যচিত্র নির্মাণ, সম্পাদনা, প্রোডাকশন, সিনেমাটোগ্রাফি ও শব্দ প্রকৌশল) আপনি ওই স্কুলে পড়ার সুযোগ পাবেন তার কমপক্ষে দুইটি বিষয়ে প্রাথমিক জ্ঞান থাকতে হবে। আর স্প্যানিশ ভাষায় দক্ষতা তো লাগবেই। এতো সব যোগ্যতা পুরোপুরি পূরণ হলেই যে-আপনি এই স্কুলে ভর্র্তির সুযোগ পাবেন বিষয়টা মোটেও এমন নয়। সবকিছুর পরও আপনাকে অবশ্যই কিউবান কমিশনের সাক্ষাৎপ্রার্থী হতে হবে। সব মিলিয়ে তারা সিদ্ধান্ত নেবেন আপনার ভর্তির ব্যাপারে।

 

৫.   

এতো গেলো ভর্তির পালা। এবার আসা যাক কীভাবে পড়াশোনা চালিয়ে যাবেন এই স্কুলে। কিউবা, লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশের বিশেষজ্ঞ শিক্ষকরা যেমন এই স্কুলে পড়ান, এর বাইরে ইউরোপ-আমেরিকার পেশাদার চলচ্চিত্রকাররাও নিয়মিত ক্লাস নিয়ে থাকেন। এদের মধ্যে রেডফোর্ড, স্টিভেন স্পিলবার্গ ও ফ্রান্সিস ফোর্ড কোপোলার মতো পরিচালকরা রয়েছেন। 

প্রতিদিন স্কুলে দুই ধাপে ক্লাস হয়ে থাকে সকাল নয়টা থেকে ১২টা এবং দুপুর দুইটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত। এছাড়া প্রতিদিন রাত আটটা থেকে ১০টা পর্যন্ত সবাইকে নিয়ম করে সিনেমা দেখানো হয়। প্রথম বর্ষে একজন শিক্ষার্থীকে ব্যবহারিক কাজের অংশ হিসেবে ১৬ মিলিমিটার ক্যামেরায় তিন মিনিটের একটি ফিকশন নির্মাণ করতে হয়। এছাড়াও ভিডিও ফরমেটে নির্মাণ করতে হয় ১০ মিনিটের একটি প্রামাণ্যচিত্র। দ্বিতীয় বর্ষে গবেষণামূলক কাজ হিসেবে নির্মাণ করতে হয় ১৬ বা ৩৫ মিলিমিটারে একটি সিনেমা। এর বাইরে দলগত ভিত্তিতে কিছু প্রজেক্টের কাজ করতে হয়। তবে সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে কাজের পরিধি অনেক বেড়ে গেছে। 

 

৬.

শুরুতে এই স্কুলে আফ্রিকা, এশিয়া, লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান শিক্ষার্থীদের বিনা পয়সায় পড়াশোনার ব্যবস্থা থাকলেও বর্তমানে তাদের কাছ থেকে টিউশন ফি নেওয়া হচ্ছে। মূলত ৯০র দশকে সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের ফলে কিউবার পুরো অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এক ধরনের সঙ্কট দেখা দেয়। এরই অংশ হিসেবে ইআইসিটিভি-এর শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টিউশন ফি নেওয়া শুরু হয়। তবে সম্প্রতি এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার চেষ্টা করছে কিউবান সরকার। স্কুলটির ২৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে কর্তৃপক্ষ আবারও শিক্ষার্থীদের শিক্ষার ব্যয় বহনের কথা জানায়। একই সঙ্গে তারা এ-জন্য একটি আন্তর্জাতিক সাহায্য তহবিল গঠনের আশাবাদ ব্যক্ত করে।

অর্থ নিয়ে সাময়িক সঙ্কট হলেও সবকিছুর ঊর্ধ্বে এখানে কিন্তু মানবিকতা ও মেধার মূল্যায়ন করা হয়। তাই এই স্কুলের লক্ষ্য শুধু শিক্ষার্থীদের শিক্ষিত করে তোলা নয় বরং বৈশ্বিক সিনেমার চলতি ধারণা পরিবর্তন করে বিশ্বের সিনেমার জন্য নতুন মেধাবীদের এগিয়ে নেওয়া, একটা পথের সন্ধান দেওয়া।

 

৭.

ইআইসিটিভি স্কুলটি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যই ছিলো মূলত পুরো লাতিন আমেরিকায় একটি চলচ্চিত্রিক পরিবেশ তৈরির। এজন্য অবশ্য তারা এখনও কাজ করে যাচ্ছে। সম্প্রতি অন্যান্য কাজের মধ্যে তারা লাতিন আমেরিকান সেই সব স্বপ্নবান যুবকদের সহায়তা করছে-যারা মেধা থাকা সত্ত্বেও কেবল টাকার অভাবে সিনেমা নির্মাণ করতে পারছে না; কিংবা সিনেমার কোনো প্রজেক্ট শুরু করে শেষ করতে পারছে না। এছাড়া লাতিন আমেরিকার চলচ্চিত্রের একটা বৃহৎ ইতিহাস রচনার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজও করছে তারা। চলচ্চিত্র ও টেলিভিশনের বিভিন্ন বিষয়ের বর্ণমালা সমন্বিত একটি স্প্যানিশ ভাষার পুরো অভিধান রচনায় অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে এই স্কুলের একটি দল। লাতিন আমেরিকান ছবির চর্চা ও প্রদর্শনী বাড়ানোর জন্য এখানকার প্রত্যেকটি দেশে ও কয়েকটি ইউরোপিয় দেশে তারা মুভি থিয়েটার নির্মাণেরও কথা ভাবছে। সঙ্গে তরুণদের উৎসাহিত করতে বার্ষিক অপেশাদার চলচ্চিত্র প্রতিযোগিতার আয়োজনতো আছেই। এই স্বপ্ন নিয়ে তীরের সন্ধানে এগিয়ে যাচ্ছে এই স্কুল সেই স্বপ্ন, সেই তরীর সাথী হয়ে উজানযাত্রার সঙ্গী করুন নিজেকে।     

ইআইসিটিভিতে যোগাযোগের ঠিকানা

EICTV-INTERNATIONAL SCHOOL OF CINEMA AND TELEVISION

San Antonio de los Ba os, Box. Air 40/41 Havana, Cuba.

Tel & Fax : (537)335196 / 335341 

mail : eictv@eictv.org.cueictv@eictv.org.cu

 

লেখক : রায়হানুল রানা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।

rayhanulrana@gmail.com

 

তথ্যসূত্র

১. পেসো দেল প্রাদো #১২৬ হলো কিউবার প্রথম সিনেমা হল।

২. ফিরদাউস, ইমরান; কিউবার চলচ্চিত্র ও একজন সক্রিয় দর্শক তৈরির কারিগর; ফ্ল্যাশব্যাক; সম্পাদনা- নাহাদ-উল-কাশেম প্রমুখ; বর্ষ-১৪, সংখ্যা-১, সেপ্টেম্বর-২০১০, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ, ঢাকা।

 

পাঠ সহায়িকা

১. Nehru, Meesha; Cinema and life; The Monash Magazine, 9 January 2011.

২. Jara, Francisco; ÔCuban film school seeks return to free tuitionÕ; AFP, 29 November 2011

৩. Payne, Chris;ÔA Vatican For Film- MakersÕ; The Guardian, 28 November 2003

৪. ÔInternational School of Cinema and TelevisionÕ; Jueves, 1 October 2009

. http://www.mac.com.mx/eictv


বি. দ্র. এ প্রবন্ধটি ২০১৩ সালের জানুয়ারির ম্যাজিক লণ্ঠনের চতুর্থ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ করা হয়।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন